অনিশ্চয়তাই জীবন

আজকে নিয়ে পাঁচদিন হল এখানে কারেন্ট নেই। কাছের হেল্থ সেন্টারে জেনেরেটর চালিয়ে কোনমতে কাজ চালাচ্ছে। এই জায়গাটার ভৌগলিক অবস্থান বুঝানো আমার মত পন্ডিতের পক্ষে একটু কঠিন। জায়গাটার নাম চাপড়; বরপেটা আর ধুবরীর মাঝামাঝি। ধুবরী টাউন থেকে তিন ঘন্টার দূরত্ব । চারিদিক পাহাড় আর গোটাকতক নদীতে ঘেরা। হাতিপোতা জায়গাটা এই চাপড় থেকে ঘন্টা দেড়েকের দূরত্ব। বেশ কিছু খরস্রোতা নদী আর পাহাড়ে মিলে একটা মনোরম পরিবেশ। গত কয়েকমাসে এখানে আসার সময় বাসে উঠে হাতিপোতা আসলে মোবাইল বাগিয়ে রেডি হয়ে থাকতাম। এবারও 16ই জুলাই বাসে বসে অপেক্ষায় ছিলাম। নদীর জল ফুঁসতে ফুঁসতে রাস্তায় উঠে এসেছে। বাস মোটামুটি কোমর জলে স্রোত ঠেলে পার হচ্ছে। সেটাই ছিল শেষ বাস ধুবরী থেকে চাপড় আসার।
 আমার কাজের এলাকাটা চারটে GP নিয়ে। ধীরেচর তরঙ্গা, বারানিতারা, ফলিমারি, বহুলপুর।  চারটে গ্রামেই জলের তলায়। মানুষ গরুবাছুর নিয়ে রাস্তায় উঠে এসেছে। মূলতঃ চাপড় মেইনরোডের ধারে প্লাষ্টিক টাঙ্গিয়ে বাথরুম ইত্যাদির ব্যবস্থা।
সামনের স্কুলে শপাঁচেক মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। ত্রাণ এসেছে চাল, ডাল সেরিল্যাক্স। গতকাল সন্ধ্যেবেলা গেছিলাম।
:ও মেডাম খবরের কাগজ থেকে আসছেন?
:না। আপনাদের মতই জলে আইটকা আছি তাই ঘুরতে ঘুরতে এলাম।
:কোথায় বাড়ী?
:কলকাতায় জল হচ্ছে?
: জানেন তামিলনাড়ুতে লোক জলের এভাবে কষ্ট পাচ্ছে।
: চারদিন পরপর বিষ্টি হলে কি ভালো হত।
এত কথার মাঝে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম এখানে সবাই খেতে পেয়েছেন?
: হ্যা এই তো রান্না চাপাইছি খেয়ে যান।
অন্ধকারে লোকগুলোর সাথে কথা বলতে সুবিধে হচ্ছিল। ওরা আমার মুখ দেখতে পাচ্ছে না ভালো। অল্পবয়সী মেয়েরা স্যানিটারি ন্যাপকিন পেয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করিনি। চিড়ে মুড়ির মত ড্রাই খাবার নেই ওখানে। খাবারজল নেই তাই দিনে দুবার রান্না করা বেশ কঠিন। লোকাল atm গুলো বন্ধ। টাকা থাকলেও সাহায্য করা কঠিন।
লজ্জায় মাথা নিচু করে বেরিয়ে আসলাম।

আজ সকালে গেছিলাম তারাঙ্গাপুর। নাঃ গ্রামের কোন অস্তিত্ব নেই। পুরোটাই জলের তলায়। ভিতরে যাওয়ার উপায় নৌকো। কিন্তু গিয়ে কি করবো! আমার কাছে কিছু নেই ওদের দেওয়ার। ফেরার পথে একজাগায় দাঁড়িয়ে মাছ ধরা দেখলাম। কিছুটা নিলাম। খেতে হবে সর্ষে বাটা আর কাঁচালঙ্কার ঝাল দিয়ে।
রাস্তাঘাট ফাঁকা শুনসান। দোকানপাট বন্ধ। জমা জলে রোদ পড়ে পচা ভ্যাকশা গন্ধ। আগামী কাল আমার ফেরার ট্রেন কুচবিহার থেকে। সকালে উঠে চেষ্টা করবো কাছকাছি কোন স্টেশনে পৌঁছাতে। সেও প্রায় ঘন্টা তিনেকের দূরত্ব। যদিও কোন গাড়ি চলছে নাএই মূহুর্তে। বঙ্গাইগাও, নলবাড়ী আর ধুবরী মিলে তিন ডিস্ট্রিক্টে আমার টিমের ঊনপঞ্চাশজন মেয়ে রেসিডেন্সিয়াল ওয়ার্কার থাকবে। জল সরলে আবার কাজ শুরু করবে। ওদের বেশিরভাগের বাড়ি বেঙ্গলে। তবে এই সপ্তাহ শেষের ছুটিতে হয়তো ওরা সবাই বাড়ি ফিরতে পারবে না। আমাদের বেশ কয়েকটি অফিসেও








জল ঢুকেছে।
এইসবের মাঝেও নানা মানবিক ও অমানবিক মুখ দেখলাম। সেসব গল্প থাক। আপাতত সব ভুলে মাছের ঝাল জিভে জড়িয়ে বেঁচে নিই একটু।

Comments

Anirneelakash said…
এমন অবস্থা যে কোনোভাবে হেল্প করাও আমাদের সাধ্যের বাইরে। বড় মন খারাপ করা লেখা
খুব মনকেমন নিয়ে ফিরবো এবার। এরকম যেন আর না দেখতে হয় এটাই প্রে করি।

Popular posts from this blog