ক্রিপলার্স
১.
আজকাল ছাদে আসতে বড় ভাল লাগে। এখানে ওখানে থোকা থোকা নাম না জানা ফুল , প্রকৃতির নিজস্ব গন্ধ আর সবুজের সমারোহ। এর পুরো ক্রেডিটাই তার নিজের। বিয়ে হয়ে এসে থেকে যত না মন দিয়ে ঘর গুছিয়েছে তার চেয়েও বেশি এই ছাদ -বাগান। পুরো কলকাতা শহর চষে ফেলেছে একেকটা দুপুর ; শপিং নয় , গাছের চারা সংগ্রহের জন্য। ইদানিং ক্রীপলারস প্রীতি টা অবসেশনএর জায়গায় চলে গেছে। সারা ছাদ জুড়ে নাম না জানা লতানে গাছে ভর্তি। এর সবটা আবার নার্সারি থেকে আনা নয় , কোনটা কোনটা রাস্তা ঘাট থেকে, লোকের বাগান থেকে তুলে আনা।
গত সপ্তাহে সোনাপুর স্টেশনের কাছে একটা নার্সারি থেকে ঝুমকো লতা আনতে গিয়ে প্রথম চোখে পড়ে গাছটা। বা বলা যায় গাছটাই ডেকে নেয় তাকে। ছোট নার্সারি। এক বিহারী বুড়ো দেখাশোনা করে। সারা জায়গাটা জুড়ে শ্যাওলা আর নানা জংলী গাছ আগাছায় ঘেরা। বেশ রহস্যময় চেহারা। এর আগেও বার কয়েক এসেছে এখানে। ঝুমকো লতার টবটা উঠিয়ে হাটা লাগানোর সময় খেয়াল করল পাশাপাশি দুটো ক্যাকটাসের টবের ফাঁক দিয়ে বেশ ডানা মেলার মত করে বেড়ে উঠছে গাছতা। আর তারই একটা থেকে শুঁড়ের মত অংশ তার জুতোর ফিতে তে জড়িয়ে আছে। যেন বা গাছটা তাকে জড়িয়ে বাড়তে চায়। বুড়ো মালিকে ডেকে জিজ্ঞেস করতেই বলল: ও তো আগাছা আছে দিদিমনি। আপনি নিবেন তুলে দিচ্ছি। নার্সারির শ্যাওলা ধরা স্যাঁতস্যাঁতে মেঝেতে দিব্বি শেকড় সহ বেড়ে উঠেছিল। অভিজ্ঞ হাতে মালি গাছটা উঠিয়ে ব্যাগে ভরে দিল। দিদিমনির পাগলামো তার অজানা নয়।
২.
সকাল আর সন্ধ্যা ছাদে উঠে চা খাবার কি যে পাগলামো শুরু হয়েছে মাঝে মাঝে বিষয়টা মাথার উপর দিয়ে চলে যায় অনিমেষের। সকালে অফিস যাওয়ার তাড়াহুড়া থাকে দুজনেরই। স্মিতার বেরোয় সাড়ে দশটায় সে নটায়। এর মধ্যে ছাদে বসে চা খাওয়ার বিলাসিতা কি মানায়! তবু যেতে হয়। অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত শরীর টা একটু কাউচে ফেলার আগেই স্মিতার চা নিয়ে ছাদে যাওয়ার আহ্বান উপেক্ষা করা মুশকিল হলেও নাচার।
ইদানিং অবশ্য উৎপাত একটু কমেছে। আজকাল একাই চলে যায় ছাদে চায়ের কাপে নিয়ে। যাবার সময় বলে : অনি হেভেনে চল্লাম, তুই কাউচ পটেটো হয়ে বসে থাক।
পটেটোই সই তবু যে রেহাই মিলেছে এই অনেক।
৩.
আজ সবে আট দিন হল সোনারপুর থেকে আনা গাছগুলোর । এরমধ্যেই ঝুমকোলতার চারা টা কেমন শুকিয়ে গেছে। যদিও গত কদিন ধরে নিম্নচাপ চলছে তাও গোটা বাগানটা যেন ধুঁকছে। কেমন যেন নিস্প্রান হয়ে গেছে তার সাধের ছাদ-বাগান, তার হেভন। আশার কথা ওই নাম না জানা চারা টা বেশ ভালরকম ডালপালা ছড়িয়ে বেড়ে উঠছে। ঝিরি ঝিরি কাঁটা ওলা পাতা আর তার সাথে তীব্র বেগুনী রঙের সরু পাইপের মত ছোট ছোট ফুল ফুটে বেশ মোহময় ব্যাপার। একটা অদ্ভুত মাদকতাময় গন্ধ আর মোলায়েম শুড় গুলোতে হাত বুলাতে বেশ লাগে।
এই যা! নটা বাজে, অনি ফোন করছে নিচ থেকে। রাতের ডিনার , কাল আবার অফিস!
৪.
আজকাল সন্ধ্যে গুলো বাড়ি ফিরলে বড্ড লোনলি ফিল হয়। স্মিতা কেমন ছাদে গিয়ে সময় কাটায়। বার দুয়েক সে নিজেও গিয়ে হাজির হয়েছে কিন্তু সময় সেরকম সুখকর হয়নি। এক কথা দু কথায় কথা কাটা কাটি আর তিক্ততা বেড়েছে। এই কদিন আগেই সন্ধে গুলো তাদের অন্যরকম ছিল। স্মিতা কাবাব ভাঁজত, লাউড স্পিকারে গান আর অল্পস্বল্প বিয়ার কখোনো বা ভাল হুইস্কি। তারপর সেইসব উদ্দাম রাত একে অপরের শরীরে ভেসে যেতে যেতে এলার্ম এর আওয়াজ জানান দিত রাত শেষ।
অক্টোবরের শেষ। আজকাল হালকা হালকা শীত লাগে। যদিও সে বরাবরই শীতকাতুরে। শুধু মাত্র লেপকম্বল হলে হয়না একটা উষ্ণ মানবশরীর নাহলে তার শীত মানে না। স্মিতার সাথে এই নিয়ে অনেক মশকরা করত একসময়। গোটা শীতকাল স্মিতাকে জড়িয়ে কম্বলের নিচে না শুলে তার ঘুম আসে না। ভিতর থেকে এক আজন্ম কাঁপুনি উঠে আসে যা লেপ কম্বলের সাধ্য নেই রোধ করে। শীতকালের একাকিত্ব কে ভয় পায় অনি।
৫.
আজকাল ছাদে আসতে বড় ভাল লাগে। এখানে ওখানে থোকা থোকা নাম না জানা ফুল , প্রকৃতির নিজস্ব গন্ধ আর সবুজের সমারোহ। এর পুরো ক্রেডিটাই তার নিজের। বিয়ে হয়ে এসে থেকে যত না মন দিয়ে ঘর গুছিয়েছে তার চেয়েও বেশি এই ছাদ -বাগান। পুরো কলকাতা শহর চষে ফেলেছে একেকটা দুপুর ; শপিং নয় , গাছের চারা সংগ্রহের জন্য। ইদানিং ক্রীপলারস প্রীতি টা অবসেশনএর জায়গায় চলে গেছে। সারা ছাদ জুড়ে নাম না জানা লতানে গাছে ভর্তি। এর সবটা আবার নার্সারি থেকে আনা নয় , কোনটা কোনটা রাস্তা ঘাট থেকে, লোকের বাগান থেকে তুলে আনা।
গত সপ্তাহে সোনাপুর স্টেশনের কাছে একটা নার্সারি থেকে ঝুমকো লতা আনতে গিয়ে প্রথম চোখে পড়ে গাছটা। বা বলা যায় গাছটাই ডেকে নেয় তাকে। ছোট নার্সারি। এক বিহারী বুড়ো দেখাশোনা করে। সারা জায়গাটা জুড়ে শ্যাওলা আর নানা জংলী গাছ আগাছায় ঘেরা। বেশ রহস্যময় চেহারা। এর আগেও বার কয়েক এসেছে এখানে। ঝুমকো লতার টবটা উঠিয়ে হাটা লাগানোর সময় খেয়াল করল পাশাপাশি দুটো ক্যাকটাসের টবের ফাঁক দিয়ে বেশ ডানা মেলার মত করে বেড়ে উঠছে গাছতা। আর তারই একটা থেকে শুঁড়ের মত অংশ তার জুতোর ফিতে তে জড়িয়ে আছে। যেন বা গাছটা তাকে জড়িয়ে বাড়তে চায়। বুড়ো মালিকে ডেকে জিজ্ঞেস করতেই বলল: ও তো আগাছা আছে দিদিমনি। আপনি নিবেন তুলে দিচ্ছি। নার্সারির শ্যাওলা ধরা স্যাঁতস্যাঁতে মেঝেতে দিব্বি শেকড় সহ বেড়ে উঠেছিল। অভিজ্ঞ হাতে মালি গাছটা উঠিয়ে ব্যাগে ভরে দিল। দিদিমনির পাগলামো তার অজানা নয়।
২.
সকাল আর সন্ধ্যা ছাদে উঠে চা খাবার কি যে পাগলামো শুরু হয়েছে মাঝে মাঝে বিষয়টা মাথার উপর দিয়ে চলে যায় অনিমেষের। সকালে অফিস যাওয়ার তাড়াহুড়া থাকে দুজনেরই। স্মিতার বেরোয় সাড়ে দশটায় সে নটায়। এর মধ্যে ছাদে বসে চা খাওয়ার বিলাসিতা কি মানায়! তবু যেতে হয়। অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত শরীর টা একটু কাউচে ফেলার আগেই স্মিতার চা নিয়ে ছাদে যাওয়ার আহ্বান উপেক্ষা করা মুশকিল হলেও নাচার।
ইদানিং অবশ্য উৎপাত একটু কমেছে। আজকাল একাই চলে যায় ছাদে চায়ের কাপে নিয়ে। যাবার সময় বলে : অনি হেভেনে চল্লাম, তুই কাউচ পটেটো হয়ে বসে থাক।
পটেটোই সই তবু যে রেহাই মিলেছে এই অনেক।
৩.
আজ সবে আট দিন হল সোনারপুর থেকে আনা গাছগুলোর । এরমধ্যেই ঝুমকোলতার চারা টা কেমন শুকিয়ে গেছে। যদিও গত কদিন ধরে নিম্নচাপ চলছে তাও গোটা বাগানটা যেন ধুঁকছে। কেমন যেন নিস্প্রান হয়ে গেছে তার সাধের ছাদ-বাগান, তার হেভন। আশার কথা ওই নাম না জানা চারা টা বেশ ভালরকম ডালপালা ছড়িয়ে বেড়ে উঠছে। ঝিরি ঝিরি কাঁটা ওলা পাতা আর তার সাথে তীব্র বেগুনী রঙের সরু পাইপের মত ছোট ছোট ফুল ফুটে বেশ মোহময় ব্যাপার। একটা অদ্ভুত মাদকতাময় গন্ধ আর মোলায়েম শুড় গুলোতে হাত বুলাতে বেশ লাগে।
এই যা! নটা বাজে, অনি ফোন করছে নিচ থেকে। রাতের ডিনার , কাল আবার অফিস!
৪.
আজকাল সন্ধ্যে গুলো বাড়ি ফিরলে বড্ড লোনলি ফিল হয়। স্মিতা কেমন ছাদে গিয়ে সময় কাটায়। বার দুয়েক সে নিজেও গিয়ে হাজির হয়েছে কিন্তু সময় সেরকম সুখকর হয়নি। এক কথা দু কথায় কথা কাটা কাটি আর তিক্ততা বেড়েছে। এই কদিন আগেই সন্ধে গুলো তাদের অন্যরকম ছিল। স্মিতা কাবাব ভাঁজত, লাউড স্পিকারে গান আর অল্পস্বল্প বিয়ার কখোনো বা ভাল হুইস্কি। তারপর সেইসব উদ্দাম রাত একে অপরের শরীরে ভেসে যেতে যেতে এলার্ম এর আওয়াজ জানান দিত রাত শেষ।
অক্টোবরের শেষ। আজকাল হালকা হালকা শীত লাগে। যদিও সে বরাবরই শীতকাতুরে। শুধু মাত্র লেপকম্বল হলে হয়না একটা উষ্ণ মানবশরীর নাহলে তার শীত মানে না। স্মিতার সাথে এই নিয়ে অনেক মশকরা করত একসময়। গোটা শীতকাল স্মিতাকে জড়িয়ে কম্বলের নিচে না শুলে তার ঘুম আসে না। ভিতর থেকে এক আজন্ম কাঁপুনি উঠে আসে যা লেপ কম্বলের সাধ্য নেই রোধ করে। শীতকালের একাকিত্ব কে ভয় পায় অনি।
৫.
অবশেষে শীত এসেছে গুটি গুটি পায়ে। কলকাতার কংক্রিট ভেদ করে দাঁত নখ বসিয়ে দিচ্ছে। দিনগুলি তবু কেটে যায়। রাত বড় বেদনাদায়ক। খানিকটা যেন ছাল ছাড়ানো মুরগীর মত নগ্ন মনে হয় নিজেকে। স্মিতার হেভন ক্রমশ ছাদ থেকে নেমে বসার ঘর হয়ে বেডরুমে ঢুকে পড়েছে। দেওয়াল বেয়ে যত্রতত্র কি এক অদ্ভুত লতানে গাছ শুড় বাগিয়ে আধিপত্য বিস্তার করছে। মাঝে মাঝে মনে হয় তার আর স্মিতার মাঝে এক অলিখিত বেড়া তৈরীর প্রচেষ্টা চলছে। স্মিতাকে আজকাল কোন ভিনগ্রহের জীব বলে মনে হয়। প্রতিটা গাছের শুঁড়ে সে হাত বোলায়, ফিস ফিসিয়ে ওঠে মাঝে মাঝে। কাল ক্রিসমাস। রাত বারোটায় তাকে জাগিয়ে মেরি ক্রিসমাস বলল স্মিতা। ঘুম চোখে স্মিতাকে জড়িয়ে নিতে নিতে একটা তীব্র সুগন্ধে ডুবে যাচ্ছিল অনি। অনেকদিনের উপোষী শরীর দুটো এক মুহূর্তের ছোয়ায় একে অপরের উপর বুভুক্ষুর মত ঝাঁপিয়ে পড়ল। দুটো শরীর তিব্র আশ্লেষে কেঁপে কেঁপে উঠল। আজ যেন একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হবার জন্য নয় বরং চির মিলনের পথের যাত্রী তারা। চারিদিকে এক অদ্ভুত মাদকতাময় গন্ধ লতানে গাছের সরস ডাল বেয়ে ফুল আর শুড় থেকে গড়িয়ে পড়ছে ঘরে। রাত বাড়ছে, ঠান্ডাও। আজ যেন দেওয়াল বেয়ে গাছগুলোও বিছানায় নেমে এসেছে লেপের নিচে সেধোবে বলে। স্মিতার হাতের বাঁধন আরও শক্ত হল। আজ একটু শান্তিতে ঘুমাবে অনি। তীব্র আলিঙ্গন চাই তার শীতার্ত শরীরে । আসুক স্মিতার হেভন নেমে ঘরের ভিতর।তাতে যদি স্মিতার স্পর্শ থাকে ক্ষতি কি!এই শীতে শান্তিতে ঘুমাবে অনি, স্মিতাও।
৬.
দরজার কাছে বেশ কিছু খবরের কাগজ আর দুধের প্যাকেটে পিঁপড়ে ঘুরছে। দূরে একটা কিছু নিয়ে কাক চিলের জরুরী মিটিং চলছে। শিবতোষ এসেছে সারামাসের মুদি বাজার দিয়ে যেতে। প্রতিমাসেই আসে। পাড়ায় শিবুর দোকান বেশ পপুলার। এরকম কবাড়ি সে মাসে একবার নির্ধারিত লিস্ট অনুযায়ী মাল পৌঁছে দেয়। কলিং বেলটা শ্যাওলা আর লতাপাতায় ঢেকে গেছে। একটানে খানিকটা টেনে ছিড়ে সরিয়ে বেল বাজাল শিবতোষ। নাহ!আজকাল আর কেউ থাকে না বোধহয় এবাড়িতে। পুরো বাড়িটাই জঙ্গলে বলা ভুল অদ্ভুত বেগুনী ফুল সহ লতায় ঢেকে গেছে। ভারী মাদকতাময় গন্ধ। নিয়ে যাবে নাকি দুগাছা ডাল। নাতনী টার আবার গাছপালার খুব শখ। ধীরে ধীরে বড় চাল ডালের ব্যাগ টা বাইকে ঝোলাতে গিয়ে দেখে এরই মধ্যে খানিকটা লতাপাতায় জড়িয়ে গেছে ব্যাগ গুলো।
সমাপ্ত।


Comments