বহু পুরানো চর্বিত চর্বন

সন্ধ্যাতারা যায় যে চলে ভোরের তারায় জাগবে ব'লে
বলে সে,যাই যাই যাই গো।
আমার মন বলে চাই চাই, চাই গো
যারে নাহি পাই গো"

যা পাওয়া যায়না সেটাই আমাদের বেশি করে লাগে। একেবারে হক কতা। সেই কবে কবিগুরু বলে গেছেন। এ বুঝি আমার তরেই লেখা।  গেলবার পুজোয় খেতে গেলাম জুনিয়র ব্রাদার্সে। তা অনেক ভেবে চিন্তে ধোসা নিলাম । ওমনি পাশের টেবুলের লোকটা শয়তানি করে ছোলে বথুরা নিল। আমার সাথে সাথে মন খারাপ হয়ে গেল। বথুরা গুলো কেমুন ফোলা ফোলা লিচচয় ধোসার চেয়ে অনেক ভাল খেতে। অথচ ঢোকার আগে মনে হচ্ছিল প্লেট জুরে ইয়া বড় ধোসা থাকবে সাথে ঘন নিষ্পাপ নারকোল চাটনি।

ঝাকগে! এ আমার স্বভাব । তা একবার  ঘুরতে যাবার প্লান করতে গিয়ে মনে হল জেবনে একবার বিদেশ যাব। ঝটাপট পাসপোর্ট করলাম। পেয়েও গেলাম হাতে। এবার টাকা জমাতে হবে। নালে যাব কিভাবে। পেথথম ঠিক হল ব্যাংকক যাব। সব্বাই যায়। তা একজন শুনে বলল সেখানে নাকি খালি অসভ্য পোডিউসার আর বেচারা নায়িকা যায়।  এহেন রেপুটেশনে দমে গিয়ে ভাবলাম তবে আমি মিশর যাব । মমি দেখব। বাজেট ঠিক হল। দুবছর লাগবে পুরো টাকা জমাতে। এইসব হিসাব কষতে গিয়ে বুজলাম এটাই বোধহয় প্রথম আর শেষ বিদেশ যাত্রা।  তাহলে তো আমি মিশর যেতে চাই না। আমি চাই আফ্রিকার জঙ্গলে কিংবা মাচচু পিচচুর দেশে যেতে। কিন্ত অত টাকা কি এক জেবনে জমবে!! তাইলে কি আমার পাসপোর্ট ভার্জিন থেকে যাবে

এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে একবছর কাটল। !! একদিন বোকাবাক্সে অনেকবারের দেখা একটা সিনেমা দেখতে দেখতে মাথাটা ঝাঁকিয়ে উঠল। রাইট! আমি আঙকোরভাট যাব । সিনেমাটার নাম ছিল লারাক্রফট্।  তারপর ছমাস নেট ঘেটে বহু পড়াশুনো করে, আপিসের বসকে পটিয়ে ছদিনের ছুটি জোগাড় করে ফাইনালি উঠলাম প্লেনে।  প্রায় এগার ঘন্টার জার্নি করে পা দিলাম কম্বোডিয়ার সিয়ম রিপ শহরে। নাহ্ এবার আর ওই ছোলে বথুরার মত আফসোস হয়নি।
অদ্ভূত প্রাণবন্ত শহর। রাতদিনের কোনো ফারাক নেই । সবসময়ই নাচ গান হই হই  চলছে।  যাইহোক পৌছে এদিক সেদিক ঘুরে হোটেলে চেক ইন করে এক লোককে পাকড়ালাম। বিভিন্ন জাগায় বেরু বেরুর জন্যি। সে ব্যাটা দরদাম করে সব ফিক্স করল। শেষে বললাম কাল সকালে গাড়ি কখন আসবে?  বলল সামটাইম সেভেন অ্যান্ড সামটাইইইম এইট ও কলক্। হতভম্ব হয়ে ভাবলাম কেসটা কি!! এত বাঙালিদের ভায়রাভাই। আরও কিছু কথাবার্তা চলার পর বুজলাম। মানে ওই সামটাইম টাই তার ইংরাজি অভিধানের একমাত্র শব্দ । সে বেচারা খেমর ভাষা ছাড়া কিছুই বোজেনা।। তার যাবতীয় কথাই শুরু হয় সামটাইম দিয়ে।   এইবার আমি চুটিয়ে ইনজিরি ছোটালাম। মানে নিশ্চিতে। ভুল ধরার লুকজন নাইযে!! তো সামটাইম আমাদের সময়মত সব জাগা ভালই ঘুরিয়েছিল

যেহেতু আমার যাবতীয় কথাবার্তাই শেষ পর্যন্ত খাবারে এসে শেষ হয়। ধরা যাক আমাকে কেউ বলল কলকাতা বেড়াতে এলে কোথায় কোথায় যাব? আমি তাকে সবার আগে ভাল খাবারের জায়গা গুলোয় যেতে বলব।  কোন নতুন জায়গায় যাওয়ার আগে আমি সেখানকার খাবার দাবার সংক্রান্ত বিষয়ে সবার আগে গবেষণা করে নিই। সিয়ম রিপ পৌছানোর আগে যথারীতি প্রচুর  পরিকল্পনা করে নিলাম। মানে কি খাব, কোথায় খাব ইত্যাদি ।
  এয়ারপোর্টে নেমে ভিসা সংক্রান্ত ঝামেলা মেটার পরই দেখলাম আমাদের হোমস্টের গাড়ি ওয়েট করছে। রওনা দিলাম । মূল শহরে পৌছে দেখলাম গোটা শহরটাই শুধুমাত্র  নানাবিধ  খাবারের দোকান ও রেষটুতে ভর্তি। আর কিছুদূর অন্তর একটা করে সুপারমার্কেট বা আমাদের এখানকার স্পেনসার টাইপ শপ। সেগুলো আবার রাত দুটো অবদি খোলা থাকে। এখানে বলে রাখি সিয়ম রিপে অ্যালকোহল ডিউটি ফ্রি ও ট্যাক্স ফ্রি।  বলা হয় পৃথিবীর সব থেকে সস্তা মদ এখানেই পাওয়া যায়। সমস্ত শহরটাই সারারাত জাগে, মদ খায়, খাবার খায় , নাচে গায়। সকালে দেরীতে ওঠে। অবিকল আমার মত।
আমরা নেমেই চেক ইন করেই বেড়িয়ে পড়লাম । খিদে পেয়েছিল খুব । অজস্র খাবারের দোকান এবং সারা পৃথিবীর সবরকম কুইজিনের সমাহার। তবু খেমর কুইজিন এখানকার নিজস্ব ঘরানা। খুজে পেতে তারই একটা ছোটখাটতে ঢুকলাম । অর্ডার করা হল কুডোস বিয়র আর ফ্রায়েড চিকন ( পেথথম দিন সেফ খেললাম) । তখন বিকাল চারটা বাজে। হঠাৎই দেখি এক প্লেট ভাত আর চিকেন ভাজা সাথে বিয়র এল। প্রশ্ন হল ভাত কেন বাবা এই অসময়ে। নাহয় ভেতো বাঙালি বলা হয় কিন্ত বিয়র আর ভাত একসাথে !! একদিনের মধ্যেই টৈর পেলাম এরা সকাল -বিকেল -সন্ধ্যা নির্বিচারে ভাত খায়। সুগন্ধি চালের আঠাল ভাত। বিয়র দিয়ে বেড়ে লাগল।
খেমর কুইজিন অন্যান্য খাবারও পরে আরও খেয়েছি। খুব হালকা মশলাদার খাবার। স্বাদ ও গন্ধ অনেকটাই আলাদা। কাঁচা গোলমরিচ ব্যাবহার বেশি।  এই রকম নানাবিধ খাবার খেতে গিয়ে আমার জাপানী সুশি খাওয়ার অভিজ্ঞতা টাও ছিল জব্বর।

চিরকালই নতুন খাবার ও রান্না সম্পর্কে আমার অসীম কৌতুহল । কম্বোডিয়া পৌছে ইস্তক আমি নানাবিধ খানা চেখে দেখলাম । এখানে মোটামুটি সবধরনের খাবার পাওয়া যায়। জাপানিজ, মেক্সিকান, ভারতীয় বা ইটালিয়ান ইত্যাদি।  উল্লেখ্য এটাই যে সব খাবার খুব সস্তা । মানে কলকাতার তুলনায় বেশ সস্তা ।

এই সকল গুরু তত্ব বুঝে নিয়ে আমি নানাবিধ খাদ্য গলাধঃকরণ করলাম। প্রথমেই জাপানিজ কুইজিন কথা বলি। জাপানীদের প্রতি আমার একটু পেরেম আচে। ওদের স্ক্রিপ্ট গুলোর প্রতি কৌতুহল থেকে দুবছর জাপানী ভাষা চর্চা করে ক্ষান্ত দিয়েছি। তবে কিনা ওদের খাবার খাওয়ার মত পকেটমানি খরচা করার ইচ্ছে কলকাতায় বসে হয়নি। এহেন  জায়গায় এসে মাত্র পাঁচ  ডলার দিয়ে (Sushi )সুশি খাওয়ার সুযোগ কে ছাড়ে। যাইহোক সুশি এবং একটা বিফের ডিশ এলো। সুশির প্লেটে সবুজ রঙের একটা আঠালো জিনিস । টুনা সুশির অদ্ভুত আঁশটে গন্ধ আর ওই সবুজ বস্তুটা মুখে দিলাম আর তার পর যে ফিলিঙ টা হল সেটা এখানে লিখছি।

তখন সন্ধে আট টা বাজে বোধ হয় । সদ্য গোটাকতক বিয়র,  দুটো টেকিলা শট, একটা গ্রে গুজ মকটেল খেয়ে গোটা দুনিয়াকে দারুণ রকম একটা জায়গা বোধ হচ্ছে। কোনো কাপলকে ঝগড়া করতে দেখলে মনে হচ্ছে বলি প্রেম করুন। কাল এই জীবন নাও থাকতে পারে ইত্যাদি  প্রভৃতি। এই অবস্থায় ওই আঁশটে গন্ধ আর সবুজ বস্তুর বিকট ঝাজেঁ আমি বাংলায় ফিরে এলাম । মাথা টাকে কেউ ঝাঁকিয়ে দিল যেন। মনে পরে গেল আমার বাড়ি গড়িয়ায়,  আমার আপিস আছে,  খিটখিটে বস আচে, দুনিয়া চোর পাজি  ইত্যাদিতে ভরতি, ভালবাসা সুনীলের বইতে আর প্রেম কেবলমাত্র রবীন্দ্র কাব্যে আচে।  ক্ষমা করবেন আমি কারোর ফুড হ্যাবিটকে খারাপ বলছি না। এই আমার ভেতো বাঙালি জিভের দোষ।  গোমাংস ভক্ষণ করিয়া কিনচিত আরাম হইয়াছিল ।
সে যাইহোক এখানকার লোকেরা কিন্ত খায়না এমন কিছুই নেই। পোকামাকড় থেকে শুরু করে কুমীর, বাদুর , গাছপালা, শ্যাওলা সবকিছুই।

Comments

Popular posts from this blog